চৌগাছায় ঐতিহ্যবাহী বলুহ্ মেলা শুরু
চৌগাছায় ঐতিহ্যবাহী বলুহ্ মেলা শুরু |
১০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে যশোরের চৌগাছার ঐতিহ্যবাহী পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) মেলা। মেলা ঘিরে এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মেলা পরিচালনা কমিটি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় পরিচালিত হবে।
মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও মেলার আসবাবপত্রের বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে আগে থেকেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করা হয়েছে। আনসার-ভিডিপি সদস্যরা থাকবেন।
এছাড়াও পুলিশের পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে মেলায় প্লাস্টিক, কাঠ ও স্ট্রিলের আসবাবপত্র, খেলনা, প্রসাধনী, গার্মেন্টস, হোটেল-বেকারি, মিষ্টির দোকান, নাগরদোলা, অ্য্যালুমিনিয়ামের সামগ্রী, ক্রোকারিজ, যাদু প্রদর্শনী, স্ট্রিলের নানা সামগ্রী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ হাজারের অধিক দোকান বসেছে। এছাড়াও কপোতাক্ষ নদে স্পিডবোড চালানো, মৃত্যুকূপে প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল চালানোর মত বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে।
বাংলা সনের ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) রওজা শরীফকে ঘিরে যশোরের চৌগাছা উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে বসে এই মেলা। হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পাশে উঁচু ঢিবির ওপর এ অঞ্চলের পীরে কামেল বলুহ দেওয়ান (রহ) এর রওজা শরীফ অবস্থিত। মেলার সময় এলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পড়ে যায় ব্যস্ততার ধুম।
এ অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে ঈদে-পূজায় না হলেও মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাই দাওয়াত করার রেওয়াজ রয়েছে। যাকে ঘিরে এ মেলা তার সম্পর্কে রয়েছে নানা মিথ। লোক মুখে প্রকাশ পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ছিল রহস্যে ঘেরা। তিনি একই উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ছেলে। তবে জন্মকাল সম্পর্কে আজও কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। জ্যেষ্ঠ ভক্তদের মতে তিনি ৩-৪ শ' বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।
তবে সাংবাদিক নাসির হেলালের লেখা 'যশোর জেলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার' এবং সাংবাদিক মাসুদ পারভেজের লেখা 'চৌগাছার পীর-দরবেশ' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দির প্রথমদিকে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গ্রন্থদুটি থেকে জানা যায়, বলুহ (রহ.) এর নামে ভারতের কলকাতা ও নদীয়া, বাংলাদেশের চৌগাছার হাজরাখানাসহ বিভিন্ন স্থানে ৫২টি থান (ইবাদতগাহ) আছে। যেখানে তার ভক্তরা বসে ইবাদত-বন্দেগি করেন। বর্তমানে উপজেলার জিওলগাড়ি, পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড়ধোপাধী গ্রামে তার থানে ছোট পরিসরে মেলা বসে থাকে। তার নামে চৌগাছার হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) দাখিল মাদরাসার নামকরণ করা হয়েছে। পীর বলুহ (রহ.) সম্পর্কে মিথ প্রচলিত আছে, 'যখন তাঁর বয়স ১০/১২ বছর তখন পিতার নির্দেশে গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন। গরু দিয়ে ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগে ক্ষেতের মালিক গরুগুলি ধরতে গেলে তিনি সব গরু বক বানিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখেন।'
পিতার মৃত্যুর পর তিনি উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের জমিতে দিনমজুর খাটতেন। একদিন সরিষা মাড়াই করতে মাঠে গিয়ে সরিষার গাঁদায় আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদ শুনে গৃহস্থ মাঠে গিয়ে দেখে সরিষার গাঁদায় আগুন জ্বলছে। তখন গৃহস্থ রাগান্বিত হলে তিনি হেসে ছাই উড়িয়ে দেখিয়ে দেন সরিষা পোড়েনি। একদিন তার মামি খেঁজুর রসের চুলায় জ্বাল দিতে বললে তিনি জ্বালানির পরিবর্তে চুলায় পা ঢুকিয়ে আগুনে জ্বাল দিতে থাকেন। এতেও তার পায়ের কোনো ক্ষতি হয়নি। এমন অনেক অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিতে থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ তার শিষ্যত্ব নেন। অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর আখ্যা পান।
তার মৃত্যুর পর গ্রামাঞ্চলের মানুষ জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে তার নামে মানত করতে থাকে। মানত পরিশোধে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হাজরাখানা গ্রামে অবস্থিত তার রওজা শরীফে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, নারকেল ও টাকাসহ নানা দ্রব্যাদি দিয়ে মানত শোধ করতে থাকে। সেখান থেকেই একসময় ভক্তদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রয়োজনে গড়ে ওঠে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) মেলা। দীর্ঘদিন থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা হতে থাকলেও বিগত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে জমজমাট মেলা। প্রতি ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা শুরু হয়ে ৩ থেকে সাত দিন মেলার আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও মেলা শুরুর ১৫-২০ দিন পূর্ব থেকে শেষের ১০-১২ দিন পর্যন্ত চলমান থাকে মেলার বেচাকেনা।
একসময় মেলায় বিশৃঙ্খলা ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০০২ সালে মেলায় ব্যাপক বোমাবাজি করে সন্ত্রাসীরা। সেসময় মেলায় কয়েকজন দোকানী ও দর্শনার্থী হতাহত হয় !
C: Daily Spandan
No comments